একটি লবনের হাজার বছরের ইতিহাস।

জার্মানির লোয়ার সেক্সনি রাজ্যের একটি ছোট্ট শহর লুনেবুর্গ, যা হামবুর্গ শহরের নিকটে অবস্থিত। বিগত ১০০০ বছর ধরে এই শহর লবনের শহর নামে পরিচিত। বিগত ১ হাজার বছর লবণ ব্যবসায় এই শহররে ছিল একক আধিপত্য। এখানে লবনের খনি আবিষ্কারের রযেছে একটি অদ্ভুত ইতিহাস। ৯৫৬ সালে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়, তখন এই এলাকার রাজার শিকারী জংগলে শিকারের জন্য বের হয়, ঠিক তখনি সে জংগল থেকে সাদা একটি প্রনীকে বের হতে দেখতে পায়। সে মনে মনে ভাবতে থাকে এই প্রানী কে রাজার জন্য নিয়ে গেলে রাজা খুব খুশি হবেন। এরপর সে সেই প্রানী কে শিকার করে এবং প্রনীটির কাছে গিয়ে দেখতে পায় প্রানীটি বন্যশুকর, কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে কেন শুকরটি সাদা হল? সে দেখতে পেল শুকরটির গায়ে সাদা সাদা কি যেন লেগে আছে। তারপর সে সেখান থেকে আগুল দিয়ে সেই সাদা দানাদার পদার্থ মুখে নিয়ে পরখ করে দেখলো। এরপর সে বুঝতে পারলো এই সাদা পদার্থগুলি আর কিছুই না বরং লবণ। তার মনে আবার প্রশ্ন জাগল লবণ এলো কোথা থেকে? সে তখন সেই শুকরটির পদচিহ্ন অনুসরণ করে দেখতে পেল একটি জলাশয় এবং সে বুজতে পারলো এই জলাশয়ে নিশ্চই লবণ আছে। তখনকার দিনে লবণ অনেক মুল্যবান ছিল, তাই এই লবন এর সন্ধান সে সেখানকার রাজাকে জানালো । মুলত সেই জলাশয় টি একটি সল্ট ডোম এর উপরে ছিল, যা ভু-চূত্যির মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। মুলত উপরের পানি সেই ভু-চূত্যির মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে লবনের সাথে মিশ্রিত হয়ে উপরে উঠে আসতো, যে গুলোকে মুলত ব্রাইন বলে। এর পর রাজা সেখান থেকে লবণ উত্তোলনের নির্দেশ দিলেন, শুরু হল লুনেবুর্গের লবণ উৎপাদন। এই সল্ট ডোম থেকে লবণ উৎপাদন সহজ ছিল না। সেই সল্ট ডোম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নদী থেকে পানি আনতে হত। পানি আনা এখনকার মত এত সহজ ছিল না যে পাম্প আর পাইপ দিয়ে পানি অনেক দূরে পরিবহণ করা যাবে? সেই সময় বাতাসের শক্তি কে কাজে লাগিয়ে নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হত, সে পানি কাঠ দিয়ে বানানো এক ধরনের অর্ধগোলাকৃতি দোনের মত, সেটিকে কাঠের পিলার দিয়ে উচু করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পানি সঞ্চালন করা হত। সেই পানি মাটির নিচে পাঠানো হত সেখান থেকে উঠে আসতো প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ব্রাইন। এই ব্রাইন যারা উঠাতো সেই সকল শ্রমিক দিনের বেশি ভাগ সময় ই নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন থাকতো, কেননা যে স্থানে এই ব্রাইন উঠানো হত সে স্থানে তাপমাত্রা আর আদ্রতা এত বেশি থাকতো যে সেখানে কাপড় পড়ে থাকা প্রায় অসম্ভব হত। এই অস্বভাবিক পরিস্থিতিতে অনেক শ্রমিক নির্মম ভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হত। এই ব্রাইন পরবর্তীতে কাঠের আগুনে জ্বাল করে শুকিয়ে তৈরি করা হত লবণ। সেই লবণ বিক্রি করে লুনেবুর্গের রাজা প্রচুর অর্থ সম্পদ অর্জন করতে থাকে এবং লুনেবুর্গ হয়ে উঠে সেই এলাকার প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। কিন্ত এই লবণ নিয়ে বাল্টিক সমুদ্র অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে দাম দর উঠানামা করে, যে কারনে লবণ কেদ্রিক বাবসা নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ঝামেলা হয়। এই ঝামেলা দুরীকরনে বাল্টিক অঞ্চলে বিভিন্ন শহরের মধ্যে একটি বাণিজ্যিকে চুক্তি হয়। এই চুক্তির মুল উদ্দশ্য ছিল সব শহরে পণ্যের দাম একই হবে, যা এখনকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষুদ্র এবং প্রাচীন রুপ। যে সব শহর এই চুক্তির আওতায় ছিল তাদের কে বলা হয় হেন্সিয়েটিক সিটি বা হান্সা স্টাড। বিগত ১ হাজার বছর ধরে এই হান্সা স্টাড গুলি প্রতি বছর বাৎসরিক সম্মেলন করে, যা এখনও বিদ্যামন। বর্তমানে আমরা যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখি তা মুলত এই হান্সা স্টাড এর ধারনা থেকে নেওয়া। ক্রমাগত লবন উত্তোলনের জন্য লুনেবুর্গ শহর দেবে যায়, ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালে নবন উৎপাদন বন্ধ করা হয়। এ থেকে এটা বোঝা যায় যে কোন স্থানের ভূতাত্ত্বিক গঠন সেই এলাকার বানিজ্যিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।